আগুনের রাত

43
0

রাত। দু-অক্ষরের মাঝে লুকিয়ে আছে কত সহস্র মায়া,কত শতাব্দীর ভালবাসা, কত যুগের হাসি, কত বছরের কান্না। কত কবি আঁধারের আলোতে খুঁজে পেয়েছে এক চিলতে কবিতা। কত বাউল সুর বেঁধেছে রাতের সুরে তাল মিলিয়ে। আকাশের মস্ত চাঁদ কতবার লুকোচুরি খেলেছে জমাট আঁধারের সাথে। কতবারই না পুকুরের পশ্চিম পাশের বাঁশ বাগানে নিকষ কালোতে আলো জ্বেলেছে জোনাকিরা। তেমনি একটা রাত আজ।

বেড়িবাঁধের পাশের ঢালু জমিতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে রানা। পাশে রমিজ,বদি। আরেকটু দূরে সোহেল। ইট বিছানো রাস্তা ধরে গুনগুন করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে কে যেন। শিবু বুঝতে পারে তার শরীর শক্ত হয়ে আসছে। ও কি ভয় পাচ্ছে? যেখানে ভয় পাওয়ার কথা সেখানে সবাই ভয় পায়।

ঘুমন্ত মা’কে সালাম করে ঘর ছেড়েছিল রানা। মাকে ছেড়ে ও এক রাতও বাইরে থাকেনি এই বাইশ বছর জীবনে। কিন্তু আজ তো যেতেই হবে। আরেক মা যে ডাকছে ওকে। ও সে ডাক না শুনে থাকবে কিভাবে? দুই ক্রোশ পায়ে হেটে নদীর ঘাটে এসে পৌছায় রানা। মাঝিকে বলা ছিল। সে বসে আছে নৌকায়। রানাকে দেখে সে নড়েচড়ে বসে বৈঠা হাতে নিলো। রানা নৌকায় উঠল। নদীর পানিতে হালকা ঢেউগুলো সরে যেতে যেতে মিলিয়ে গেল দূরে। আড়াই দিন পর সে পৌছাল সীমান্তে। কখনো হেটে কখনো নৌকায়। আবার কখনো মহিষের গাড়িতে চেপে এতদূর এসেছে সে। মা যে ডাকছে।

দূরে একটা শিয়াল ডেকে উঠল কোথায় যেন। একবার, দুবার, তিনবার। এটা নিশ্চয়ই রহমত হবে। রমিজ উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত রাস্তার ওপাশে চলে গেল। সোহেলের হাত মুঠো করা শক্তভাবে। পাড়ায় ক্রিকেটের পেস বোলার সোহেল। ওর হাতে লাল টেপ পেঁচানো বল মানাতো ভাল। আজ বল না, ধাতব একটা মৃত্যুগোলা হাতে নিয়ে শুয়ে আছে সে। জিপগাড়ির শব্দ কানে আসছে। শব্দ কাছে আসছে দ্রুত। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল রাস্তার উপর। গুড়ুম। কুকুরের চিৎকার থেমে গেল চিরতরে। রানার কপালে ঘাম জমছে এই শীতের রাতেও। তখনি সোহেল লাফিয়ে উঠে হাতের বস্তটার আংটা খুলে ছুড়ে মারলো জিপের দিকে পুরনো ভঙ্গিমায়। রাস্তার ওপার থেকে রমিজ চিৎকার করে উঠল। জয় বাংলা। আঁধারের মধ্যে আতশবাজির মত জ্বলছে ওর হাতের নলটা। সেই নল থেকে বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে আসছে সীসার মৃত্যুদূতগুলো। বদির মেশিনগানও গর্জে উঠল। জীপ থেমে গেছে। ভেতরের পাকিগুলো বেড়িয়ে পড়ল। তাদের হাতে ভারী রাইফেল। সবাই এগিয়ে যাচ্ছে রমিজকে লক্ষ্য করে। পজিশন ঠিক করে নিল রানা। সমস্ত শক্তি দিয়ে ট্রিগার টেনে ধরল সে। কয়েকটা মিলিটারি টের পেয়ে গেছে ওর অবস্থান টের পেয়ে গিয়ে এদিকেই আসছে। রানা উঠে দাঁড়াল। ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে হাতে। ও এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। দুজন মিলিটারি ছিটকে পড়ল। একজন বাকি । রানা নিশানা ঠিক করল। তখনি একটা মৃত্যুদূত এসে আপন করে নিল রানাকে। পড়ে গেল রানা। মিলিটারিটা বুঝলো এদিকে ক্লিয়ার। সে এখন বদির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রানা হাতড়ে হাতড়ে বন্দুকটা হাতে নিল। কিন্তু না। সে পারল না। আবার পড়ে গেল। আঁধারের মাঝেও কেমন যেন আরও আঁধার লাগছে সবকিছু। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা সে। চোখ সয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে রানা। চোখ সয়ে গেল না। চোখ বুজে গেল ওর। কে যেন ডাকছে ওকে। “আয় বাপ আমার। কই গেছিলি তুই না বলে আমাকে?” রানা মিলিয়ে যাচ্ছে। অস্ফুট স্বরে সে প্রায় ফিসফিস করে বলল “জয় বাংলা”। রমিজ,বদি সবাই ছুটে আসছে ওর দিকে। তারা আসার আগেই চলে গেল রানা। ও জানতেও পারল না যে ওর মা ক্যাম্পে বন্দী হয়ে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কিছুক্ষন আগেই পাড়ি জমিয়েছেন অজানার দেশে।

রাত বাড়ছে। এ রাতের একটুও ভিন্নতা নেই। একটুও বিশেষত্ব নেই। মেঘের আড়ালে মুখ লুকালো চাঁদটা। দূরে কোথায় যেন শিয়াল ডেকে উঠল একটা।

-Roy (2016)

Roy
WRITTEN BY

Roy

মধ্যরাতের আগন্তুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *